সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক, একুশের কন্ঠ : আমার মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা প্রথম শেখা তা প্রিয় বাংলা ভাষা। বাংলা আমার রক্তে মেশা তাই এই বাংলা ভাষাতে কথা বলে কিংবা শুনে আমি যে তৃপ্তি লাভ করি তা অন্য কোন ভাষা বলে বা শুনে তৃপ্তি পাইনা। মায়ের সঙ্গে যেমন নাড়ির যোগসূত্র ঠিক তেমনি ভাষার সাথে প্রাণের সূত্র। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে। সবার কাছেই তার মাতৃভাষা প্রিয় হয়ে থাকে।
আমরা বাঙালি জাতি, আমাদের নিজস্ব ভাষা বাংলা। এ ভাষায় বাঙালিরা একে অপরের সাথে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। বাংলা ভাষায় কথা বলে বা লিখে যেভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি তা অন্য ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যে যে দেশের লোক সে সে দেশের ভাষায় কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে কেননা ওটা তাদের মাতৃভাষা, মাতৃভাষার প্রতি সকলের সতন্ত্র মমত্ববোধ কাজ করে বলেই মাতৃভাষা এতো প্রিয়।
বাংলা ভাষা-আন্দোলনের বর্তমান বয়স ৭২ বছর হয়ে গেছে। আমাদের এই বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাস আমাদের আন্দোলিত করে, করে উজ্জিবিত। চোখের সামনে তুলে ধরে রক্তে লেখা বর্ণমালার নানা অবকাঠামো। একমাত্র বাংলাদেশের বাঙালী ছাড়া পৃথিবীর এমন কোন জাতি নেই যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। এই ভাষার বর্ণগুলো রাজপথে রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। এই ভাষার পরতে পরতে রক্ত আছে। এই রক্ত আমাদের ভাইদের রক্ত।
১৯৫২ সালের অমর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমেছিলো পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেরা। মিছিলে পশ্চিম পাকিস্তানের হায়েনারা গুলি চালালে সেখানে হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। তাদের সেই মহান আত্মত্যাগের বিনিময়েই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে বাংলা। ঐদিন যদি ঢাকার রাজপথে রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম না হতো তাহলে বিশ্ব ভাষার অভিধানে বাংলা নামের কোনো ভাষা থাকতো কি না সে বিষয়ে সন্দেহ ছিলো। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের রেশ ধরেই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতায় জন্ম হয় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক নতুন এক মানচিত্রের।
আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় বাংলা ভাষা তার সঠিক মূল্যায়ন পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান এ সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘভুক্ত দেশসমূহে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করা হয়ে থাকে। ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা বাংলাকে সকল ভাষার মধ্যে আলাদা একটি সম্মান এনে দিয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার দেশের অফিস-আদালতে কাজকর্মে ভাষা হিসেবে বাংলাকে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন।
আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও এখন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে কারিগরি ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়ে উঠেনি। অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তারগণ তাদের কর্মপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপত্র ইংরেজীতে লিখে থাকেন যা অনেকেরই বোধগম্য হয়না। আইনি ভাষা এবং উচ্চতর ডিগ্রির পাঠ্যবই এখনও ইংরেজিতে রচিত। আজও কোর্টে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
বাস্তবতায় আজ দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার কত ভাগ নিশ্চিত হয়েছে! বিদেশি ভাষার যাতাকলে পড়ে বাংলা ভাষা আজ কতখানি লাঞ্ছিত! আমরা ভাষার প্রতি ভালোবাসা কতটুকু দেখাতে পাচ্ছি! বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হয়নি। যে ভাষার জন্যে এতো আত্মত্যাগ সেই বাংলা ভাষাই আজ এদেশে অবহেলিত। সমগ্র বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে একটি শ্রেণী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন।
বিত্তবানরা অঢেল অর্থ খরচ করে তাদের সন্তানদেরকে বেসরকারি ইংলিশ মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনা করাচ্ছেন। বিদেশি নির্দেশে পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে এখনও বাংলা পাঠ্য নেই। যা বাংলা ভাষাকে চরম অবহেলা করাই বলা চলে। এই চিত্রের পরিবর্তন করতে হবে। যদিও ইংরেজী মাধ্যম প্রয়োজন আছে তবে বাংলাকে অবহেলা করে নয়। বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শেখা যেতেই পারে। আর তাই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে উচ্চতর শিক্ষার দিকে যেতে হবে।
ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির একুশ এলেই আমাদের মধ্যে এক ধরণের চেতনা জাগ্রত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ নানা মত প্রকাশ করে থাকে যা বাস্তবতা বিবর্জিত। এই চেতনাগুলো বাস্তবতার আলোকে যেনো হয় এবং বাংলা ভাষার মর্যাদাকে কিভাবে আরও বৃদ্ধি করা যায় তার জন্য সর্ব মহল থেকে চিন্তা করতে হবে। একুশ এলেই আমাদের মধ্যে যে চেতনার জাগ্রত হয় তা যেন সারা বছরই থাকে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, লক্ষ্য রাখতে ভাষার সঠিক ব্যবহারের দিকে।
তারিখ:-২০-০২-২০২৪
আবুল বাশার শেখ
কবি, গল্পকার, সংবাদকর্মী
সাবেক দপ্তর সম্পাদক,
ভালুকা প্রেসক্লাব
ভালুকা, ময়মনসিংহ।
মোবাইলঃ- ০১৯১৬৫৯৫৪৪০,০১৭১৭০৩৯৮৭৯